কেন স্বামীরা স্ত্রীর মৃত্যুর পর অল্পদিন বাঁচেন

কেন স্বামীরা স্ত্রীর মৃত্যুর পর অল্পদিন বাঁচেন? গভীর বিশ্লেষণ

একটি অস্বাভাবিক কিন্তু সত্য ঘটনা

আপনি কি কখনো লক্ষ্য করেছেন যে অনেক দম্পতির ক্ষেত্রে স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী অল্প কয়েক মাস বা বছরের মধ্যেই মারা যান? এই ঘটনাটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে গবেষকদের নজর কেড়েছে। বিধুর মৃত্যুর হার আশ্চর্যজনকভাবে বেশি, বিশেষ করে বয়স্ক দম্পতিদের মধ্যে। 

pic


এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিত জানবো কেন স্বামীরা প্রিয়তমার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন বাঁচেন না, এর পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণগুলো কী এবং কীভাবে এই ঝুঁকি কমানো যায়।

শোকের ভার: মানসিক চাপ যে শারীরিক ক্ষতি করে

গবেষণায় দেখা গেছে, স্ত্রীকে হারানোর পর পুরুষদের মধ্যে তীব্র শোক শারীরিকভাবে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় "ব্রোকেন হার্ট সিন্ড্রোম" বা Takotsubo cardiomyopathy। হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা হঠাৎ করেই কমে যায় শোকের তীব্রতায়। স্বামীরা স্ত্রীর মৃত্যুর পর যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেন তা সরাসরি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

জীবনসঙ্গী হারানোর প্রভাব: দাম্পত্য বন্ধনের গুরুত্ব

দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে হারানো যে কোনো মানুষের জন্যই কষ্টদায়ক, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে এই প্রভাব বেশি দেখা যায়। বৈবাহিক সম্পর্ক শুধু আবেগিকই নয়, শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীরা প্রায়ই নিজেদের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দেন, যা তাদের আয়ু কমিয়ে দেয়। গবেষকরা একে বলেন "Widower Effect" বা বিধু প্রভাব।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অবহেলা: কে আর যত্ন নেবে?

অনেক বয়স্ক পুরুষই তাদের দৈনন্দিন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল। ওষুধ খাওয়ার সময় মনে করিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া - এসব কাজ সাধারণত নারীরাই করেন। যখন স্ত্রী মারা যান, স্বামীরা প্রায়ই নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা করেন, ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: একাকীত্ব যে হত্যা করে

স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীরা সাধারণত বেশি একাকীত্ব বোধ করেন। নারীরা সাধারণত সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় বেশি দক্ষ হন। যখন তারা মারা যান, স্বামীরা প্রায়ই সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ডিপ্রেশন, উদ্বেগ এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে।

খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন: কে আর রান্না করবে?

অনেক পুরুষই বয়সকালে রান্নার কাজে ততটা দক্ষ নন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তারা প্রায়ই পুষ্টিকর খাবারের বদলে বাইরের খাবার বা অসম্পূর্ণ খাদ্যাভ্যাসের দিকে ঝুঁকেন। এই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের আয়ু কমিয়ে দেয়।

অর্থনৈতিক চাপ: একা সংসার চালানোর কষ্ট

স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেক স্বামীই আর্থিক সমস্যায় পড়েন, বিশেষ করে যদি স্ত্রী সংসারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকতেন। এই নতুন আর্থিক চাপ তাদের মানসিক চাপ বাড়ায়, যা সরাসরি শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, আর্থিক অনিশ্চয়তা কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

জীবনযাপনের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলা: উদ্দেশ্যহীনতা

দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে হারানোর পর অনেক পুরুষই জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাদের কাছে জীবন অর্থহীন মনে হতে শুরু করে। এই মানসিক অবস্থাকে বলা হয় "bereavement effect" বা শোকজনিত প্রভাব। যখন কেউ জীবন নিয়ে আর আগ্রহী থাকে না, তখন শরীরও ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করে। ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান ও ধূমপান: আসক্তির দিকে ঝুঁকি

স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেক পুরুষই মানসিক কষ্ট লাঘবের জন্য মদ্যপান বা ধূমপানের পরিমাণ বাড়িয়ে দেন। এই অনিয়ন্ত্রিত আসক্তি লিভার সিরোসিস, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অন্যান্য মারাত্মক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বিধুরা সাধারণ পুরুষদের তুলনায় মদ্যপান ও ধূমপানে বেশি আসক্ত হন।

ঘুমের সমস্যা: অনিদ্রা যে স্বাস্থ্য নষ্ট করে

স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীরা প্রায়ই ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। অনিদ্রা (insomnia) বা অল্প ঘুম তাদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে। দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের অভাব হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাসের মতো সমস্যা সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে এই অনিদ্রাই তাদের আয়ু কমিয়ে দেয়।

কীভাবে এই ঝুঁকি কমাবেন? কিছু পরামর্শ

স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীরা যাতে দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বাঁচতে পারেন, তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

  • পরিবার ও বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন
  • নতুন কোনো শখ বা সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িত করুন
  • স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখুন
  • নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন
  • মদ্যপান ও ধূমপান এড়িয়ে চলুন
  • প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন

সচেতনতাই পারে জীবন বাঁচাতে

স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীরা যে দ্রুত মারা যান, এটি কোনো অমোঘ নিয়ম নয়। সচেতনতা এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। পরিবার, বন্ধু এবং সমাজের সদস্যরা যদি বিধুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেন, তাহলে তারা দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বাঁচতে পারবেন। মনে রাখবেন, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

ডিজিটাল আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url